Best Child Neurologist

আজ ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম দিবস

অটিজম ও বাংলাদেশ

আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—‘এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি’। অটিজম নিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু

অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা, যেখানে শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা লক্ষ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিস-অর্ডার বলেও থাকেন।শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। রবার্ট এল বার্কার উল্লেখ করেছেন, অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা, এতে ব্যক্তির মধ্যে বাইরের জগৎ সম্পর্কে অতি সামান্য আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য মানুষ বা বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। বরং তার সব মনোযোগ যেন তার ইচ্ছা ও অনুভূতির মধ্যেই মগ্ন থাকে।অটিস্টিক শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়, যেমন—

সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা

অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কী করছে তা নিয়ে কৌতূহল না থাকা এবং অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা।

যোগাযোগ স্থাপনে বাধা

মুখের ভাষায় কথা বলতে না শেখা, কিছু কথা বলতে পারলেও অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় সমর্থ না হওয়া এবং ইশারা-ইঙ্গিত করতে না পারা।

আচরণের ভিন্নতা

পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা, একই কাজ বারবার করা এবং একই খেলা বারবার খেলা।

অটিস্টিক শিশুর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও আচরণের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে অটিস্টিক শিশুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আরো বৈশিষ্ট্য হলো—

♦ নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না।

♦ কোনো খেলনা বা আনন্দদায়ক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় না বা আঙুল দিয়ে ইশারা না করা বিশেষ আচরণ বারবার করতে চায়, যেমন—বারবার হাত নাড়ানো।

 কোনো বিশেষ বস্তুর প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তি থাকা।

♦ ভাষার ব্যবহার রপ্ত করার পর আবার তা ভুলে যাওয়া।

♦ অতিরিক্ত রুটিন মেনে চলা।

অটিজমের কারণ

অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা না গেলেও কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, অটিজমের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে—জিনগত সমস্যা এবং পরিবেশগত সমস্যা। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ডিএনএ কপি নাম্বার ভেরিয়েন্ট নামক ত্রুটি বহন করে।

পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ জিনের ওপর কাজ করে স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে। এই বিষাক্ত উপাদান গর্ভের শিশু এবং শিশুর বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ের মস্তিষ্কের কোষকে ধ্বংস করে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য অটিজমের জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মার্কারি, লেড, পোকা-মাকড় মারার বিষ, খাদ্য সংরক্ষণ করার রাসায়নিক দ্রব্য, খাদ্য সৌন্দর্য বৃদ্ধির কৃত্রিম রং ইত্যাদি। কখনো কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মস্তিষ্কের কিছু অসুবিধা লক্ষ করা যায়, যেমন—

♦ মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া।

♦ মস্তিষ্কের নিউরোকেমিক্যালের অসামঞ্জস্যতা।

♦ শিশুর জন্ম-পূর্ব বা জন্ম-পরবর্তী কালের কোনোরূপ সংক্রমণ।

♦ মস্তিষ্কের গঠনগত ত্রুটি।

বাংলাদেশের অটিজমের অবস্থা

বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ১৯৮০ সালে প্রতি দুই হাজার ৫০০ জনে একজন ছিল অটিস্টিক এবং ২০১০ সালে ছিল ১১০ জনে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। বর্তমানে ৫৪ জনে একজন (সিডিসি, ২০১৮ থেকে)। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপে (২০২০-২১) বর্তমানে বাংলাদেশে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬১ হাজার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি জরিপে (২০১৩ সাল) বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। সম্প্রতি ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিস-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)’-এর এক গবেষণায় বাংলাদেশে তিন বছরের নিচের শিশুদের অটিজমের হার ১০ হাজার জনে ১৭ জন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ৩৪টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। দেশের সব জেলার প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম কর্নার (১০৭টি) স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অটিজম রোগীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলোর সংখ্যা খুবই কম।

অটিজম শিশুর ব্যবস্থাপনা

গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া গেলে অটিজম নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু প্রাপ্তবয়সে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে। শৈশবে নেওয়া পদক্ষেপ বলতে বোঝায় জন্মের ১৮ থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে অটিজম শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুকে সঠিক চিকিত্সা দেওয়া। অটিস্টিক শিশুর প্রধান চিকিত্সা স্পিচ থেরাপি, নিউরোবিহেভিওরাল থেরাপি। অতিরিক্ত আচরণগত সমস্যা, ঘুমের সমস্যা ও শারীরিক সমস্যার জন্য মেডিক্যাল চিকিত্সা এবং বিশেষ স্কুলে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের করণীয়

কোনো শিশুর মধ্যে যদি অটিজমের কোনো বৈশিষ্ট্য ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে তার মা-বাবা লক্ষ করে থাকেন, তাহলে প্রথমে অবশ্যই অতি দ্রুত শিশুকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সককে দেখানো উচিত। জেনে রাখা ভালো যে বেশির ভাগ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ জনে একটি অটিস্টিক শিশুর মধ্যে ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষতা থাকে। তাই এই বিশেষ শিশুকে ঠিকমতো পরিচর্যা করে সমাজে অন্যান্য শিশুর কাছাকাছি করে গড়ে তুলতে পারলে আমাদের দেশব্যাপী এ আন্দোলনে আমরা জয়ী হব।

সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *