ডাউন সিনড্রোম কী : ডাউন সিনড্রোম একটি শিশুর বংশানুগতিক সমস্যা এবং শরীরে ক্রোমোজোমের একটি বিশেষ অবস্থা। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির প্রতিটি দেহকোষে ২১তম ক্রোমোজোমে একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির ২১তম ক্রোমোজোমে তিনটি ক্রোমোজোম থাকে, যাকে ‘ঞৎরংড়সু ২১’ বলা হয়।
নামকরণ : ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সারে শহরের এক মানসিক প্রতিবন্ধী আবাসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট জন ল্যাংডন ডাউন খেয়াল করেন প্রতিবন্ধীদের মধ্যে একাংশ চেহারায় অন্যদের থেকে একটু আলাদা। এদের মুখ একটু চ্যাপ্টা, ঘাড়টা ছোট। ডাউন এদের মোঙ্গলয়েড নাম দেন। এটি ডাউন’স সিনড্রোম বা শুধু ডাউন সিনড্রোম বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্থান পায়।
দেশে এর মাত্রা কেমন? আমাদের দেশে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশে^ প্রতি ৮শ শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৭ মিলিয়ন ডাউন সিনড্রোম লোক রয়েছে। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ হাজার ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মায়। সে হিসাবে প্রতিদিন ১৫ জন ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্ম নেয়।
চেনার উপায় : চিকিৎসকরা বলেন, মানবদেহে ডিএনএ বা ক্রোমোজোমের অসামঞ্জস্য দেখা দিলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এই শিশুদের মাংসপেশির শিথিলতা, কম উচ্চতা, চোখের কোনা ওপরের দিকে ওঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোট কান, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা ও জিভ বের হয়ে থাকা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এ ছাড়া কানে কম শোনা, কথা বলতে দেরি হওয়া, কম বুদ্ধি ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়। অনেক সময় ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গে জন্মগত হার্টের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যাও থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে ডাউন শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় : গর্ভাবস্থার প্রথম ২৪ সপ্তাহের মধ্যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম রোগটি শনাক্ত করা যায়। যেমনÑ আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর নাকের হাড় দেখা, মায়ের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোমের উপস্থিতি নির্ণয়, ভ্রƒণের কোষ নিয়ে পরীক্ষা করা, এসব পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির ডাউন সিনড্রোম আছে কিনা তা আজকাল সহজেই যাচাই করা যায়।
আশার ব্যাপার হলো সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নির্দেশনায় গর্ভকালীন ডাউন সিনড্রোম শনাক্তকরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা (এন্টিনেটাল আল্ট্রা সাউন্ড, মায়ের রক্তের পরীক্ষা : পিএপিপি, বিটাএইচসিজি ইত্যাদি) বিএসএমএমইউতে শুরু হয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশে গর্ভকালীন ডাউন সিনড্রোম নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা : অনেক সময় ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গে হার্টের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা থাকতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে ডাউন শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।
যেহেতু মায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাউন শিশু হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে, তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধিক বয়সে, বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে মা হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়। মায়ের আগের সন্তানটি যদি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত থাকে তবে পরের বার সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আজ ২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস। ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এ দিনটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর সরকারিভাবে ডাউন সিনড্রোম দিবস পালিত হচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবাই ডাউন সিনড্রোমের প্রতি সচেতন হই এবং এই শিশুদের প্রতি আরও যতœবান হই।
অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু, চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা